গুরুর প্রতি শিষ্যের খোঁচা
গীতার প্রথম অধ্যায়, তৃতীয় শ্লোক
আগের শ্লোকে আমরা দেখেছিলাম, রাজা দুর্যোধন পাণ্ডবদের সৈন্যসজ্জা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে ছুটে গেছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি কী বললেন?
দুর্যোধন কেবল তথ্য দিতে যাননি, তিনি চেয়েছিলেন গুরুর মনে আগুন জ্বালাতে। এই শ্লোকটি হলো কূটনীতির এক চমৎকার উদাহরণ, যেখানে শিষ্যের মুখে গুরুর পুরনো ভুলের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
গীতার বানী: শ্লোক ও সরল অর্থ
দুর্যোধন গুরু দ্রোণাচার্যকে বললেন:
"পশ্যৈতাং পাণ্ডুপুত্রাণামাচার্য মহতীং চমূম্ ।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা ।।"
(শ্রীমদ্ভাগবদগীতা ১/৩)
সরল বাংলা ভাবার্থ: হে আচার্য, আপনার বুদ্ধিমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র (ধৃষ্টদ্যুম্ন) দ্বারা ব্যূহাকারে (কৌশলগতভাবে) সজ্জিত পাণ্ডবদের এই বিশাল সৈন্যবাহিনী দর্শন করুন।
গভীর বিশ্লেষণ: শব্দের আড়ালে খোঁচা
দুর্যোধন কেন 'দ্রুপদপুত্র' ও 'তব শিষ্য' বললেন?
দুর্যোধন খুব হিসাব করে শব্দ চয়ন করেছেন। তিনি সোজা বলতে পারতেন "পাণ্ডবদের সেনাপতিকে দেখুন"। কিন্তু তা না বলে তিনি এমন কিছু বললেন যা দ্রোণাচার্যের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো ছিল।
১. অতীতের শত্রুতা
দুর্যোধন ইচ্ছে করেই 'দ্রুপদপুত্র' নামটি উল্লেখ করেছেন। রাজা দ্রুপদ ছিলেন দ্রোণাচার্যের চিরশত্রু। দ্রুপদ যজ্ঞ করে এমন এক পুত্র (ধৃষ্টদ্যুম্ন) চেয়েছিলেন যে দ্রোণাচার্যকে হত্যা করবে। সেই ধৃষ্টদ্যুম্নই আজ পাণ্ডবদের সেনাপতি।
২. গুরুর উদারতা বা 'ভুল'
দ্রোণাচার্য জানতেন ধৃষ্টদ্যুম্ন তাকে মারার জন্যই জন্মেছে। তবুও, ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন শিক্ষা নিতে এসেছিলেন, দ্রোণাচার্য তাকে ফেরাননি। দুর্যোধন 'তব শিষ্যেণ' (আপনার শিষ্য) বলে খোঁচা দিলেন—"দেখুন আপনার উদারতার ফল! যাকে আপনি সব শিখিয়েছেন, সে আজ সেই বিদ্যা আপনার বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করছে।"
৩. সতর্কবার্তা
দুর্যোধনের মূল উদ্দেশ্য ছিল গুরুকে সতর্ক করা। তিনি পরোক্ষভাবে বলছেন, "গুরুদেব, এবার আর দয়া দেখাবেন না। আপনার প্রিয় শিষ্য বা পাণ্ডবদের প্রতি দুর্বলতা দেখালে আমাদের হার নিশ্চিত।"
আমাদের জীবনে এই শিক্ষার প্রয়োগ
দুর্যোধনের মতো আমরাও অনেক সময় নিজেদের ভুল ঢাকতে বা অন্যকে উত্তেজিত করতে অন্যের অতীত ভুলের কথা মনে করিয়ে দিই।
আত্ম-জিজ্ঞাসা:
কারও বিশ্বাস বা উদারতাকে কি আমরা দুর্বলতা মনে করি? দ্রোণাচার্য শত্রুপুত্রকেও শিখিয়েছিলেন—এটি তাঁর মহানুভবতা। কিন্তু দুর্যোধন সেটাকে দেখছেন 'ভুল' হিসেবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
মহৎ মানুষেরা শত্রুর সাথেও ন্যায়ের আচরণ করেন, আর সংকীর্ণমনা লোকেরা সেই মহত্ত্বকেও সন্দেহের চোখে দেখে।
No comments:
Post a Comment