শত্রুর শক্তি যখন ভয়ের কারণ
পাণ্ডব পক্ষের মহারথীগণ (শ্লোক ৪-৬)
দুর্যোধন কেবল পাণ্ডবদের ব্যূহ দেখেই ক্ষান্ত হননি। তিনি গুরু দ্রোণাচার্যকে একে একে শত্রুপক্ষের প্রধান যোদ্ধাদের নাম বলে শোনাচ্ছেন।
কেন দুর্যোধন এতগুলো নাম নিলেন? এই নামের তালিকার পেছনে কি শুধুই পরিচয় করানোর উদ্দেশ্য ছিল, নাকি লুকিয়ে ছিল তাঁর গভীর উদ্বেগ? আসুন দেখি কুরুক্ষেত্রের সেই মহারথীরা কারা ছিলেন।
গীতার বানী: শ্লোক ৪, ৫ ও ৬
"অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জুনসমা যুধি।
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ॥ ৪॥"
অনুবাদ: এখানে ভীম ও অর্জুনের সমান শক্তিশালী বীর ধনুর্ধরগণ আছেন—যেমন যুযুধান (সাত্যকি), বিরাট এবং মহারথী দ্রুপদ।
"ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশিরাজশ্চ বীর্যবান্।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ॥ ৫॥"
অনুবাদ: আরও আছেন ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্যবান কাশিরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ এবং নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য।
"যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্যবান্।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব এব মহারথাঃ॥ ৬॥"
অনুবাদ: পরাক্রমশালী যুধামন্যু, শক্তিশালী উত্তমৌজা, সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র—এঁরা সকলেই মহারথী।
যোদ্ধাদের পরিচয় ও গুরুত্ব
দুর্যোধন যাদের নাম নিলেন, তারা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
১. ভীম ও অর্জুনের সমকক্ষ
- সাত্যকি (যুযুধান): অর্জুনের প্রিয় শিষ্য, কিন্তু গুরুর চেয়েও কোনো অংশে কম নন।
- বিরাট: মৎস্য দেশের রাজা, যার রাজ্যে পাণ্ডবরা এক বছর লুকিয়ে ছিলেন।
- দ্রুপদ: দ্রোণাচার্যের চিরশত্রু এবং পাণ্ডবদের শ্বশুর।
২. আত্মীয় ও মিত্রপক্ষ
- ধৃষ্টকেতু: চেদী রাজা শিশুপালের পুত্র। কৃষ্ণ তার বাবাকে মারলেও সে পাণ্ডবদের পক্ষে।
- কুন্তিভোজ ও পুরুজিৎ: সম্পর্কে পাণ্ডবদের মামা (কুন্তীর ভাই)।
- শৈব্য: যুধিষ্ঠিরের শ্বশুর এবং একজন মহান রাজা।
৩. নতুন প্রজন্ম (তরুণ রক্ত)
যুদ্ধ শুধু বয়স্কদের নয়, তরুণরাও সমানভাবে প্রস্তুত:
- অভিমন্যু (সৌভদ্র): অর্জুন ও সুভদ্রার বীর পুত্র।
- দ্রৌপদেয়: দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র (প্রতিবিন্দ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক, শ্রুতসেন)।
- যুধামন্যু ও উত্তমৌজা: পাঞ্চাল দেশের দুই বীর ভাই, যারা অর্জুনের রথের চাকা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন।
বিশ্লেষণ: 'মহারথী' কে?
দুর্যোধন সবাইকে 'মহারথী' বলেছেন। শাস্ত্র অনুযায়ী মহারথী কে?
"যিনি একা দশ হাজার ধনুর্ধর যোদ্ধার সাথে লড়াই করতে পারেন এবং অস্ত্র চালনায় পরম দক্ষ, তিনিই মহারথী।"
দুর্যোধনের মনস্তত্ত্ব
দুর্যোধন এতগুলো নাম নিলেন মূলত দুটি কারণে:
- ভয় ও সতর্কতা: তিনি গুরুকে বোঝাতে চাইলেন, "এরা সাধারণ কেউ নয়, এদের হালকাভাবে নেবেন না।"
- দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া: তিনি পরোক্ষভাবে বলছেন, "গুরুদেব, আপনার সামনে আপনার নিজের আত্মীয় (কুন্তিভোজ) এবং ছাত্ররাও (সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন) আছে। যুদ্ধে মায়া ত্যাগ করুন।"
আমাদের জীবনে এই শিক্ষা
বিপদকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করুন:
দুর্যোধনের মতো আমাদেরও জীবনের সমস্যাগুলোকে বা বিপক্ষকে সঠিকভাবে চিনতে হবে। সমস্যা ছোট মনে করে অবহেলা করলে তা পরাজয়ের কারণ হতে পারে। প্রস্তুতি হতে হবে পূর্ণাঙ্গ।
No comments:
Post a Comment