ভয়ের মুখোশ ও দুর্যোধনের কূটনীতি
গীতার প্রথম অধ্যায়, দ্বিতীয় শ্লোক
প্রথম শ্লোকে আমরা দেখেছিলাম ধৃতরাষ্ট্রের উৎকণ্ঠা। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, "কুরুক্ষেত্রে আমার ছেলেরা আর পাণ্ডবরা কী করছে?"
দ্বিতীয় শ্লোকে সঞ্জয় সেই উত্তরের শুরুটা করছেন। আর এই শুরুতেই আমরা দেখতে পাই কৌরবদের প্রধান নেতা, দুর্যোধনের মানসিক অবস্থা। হাজার হাজার সৈন্যের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কী ভাবছিলেন?
গীতার বানী: শ্লোক ও সরল অর্থ
সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন:
"সঞ্জয় উবাচ ।
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা ।
আচার্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীত্ ।।"
(শ্রীমদ্ভাগবদগীতা ১/২)
সরল বাংলা ভাবার্থ: সঞ্জয় বললেন: তখন পাণ্ডব সৈন্যদের ব্যূহ রচনা (কৌশলগত সাজসজ্জা) দর্শন করে, রাজা দুর্যোধন তাঁর গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে গমন করলেন এবং এই কথাগুলো বললেন।
গভীর বিশ্লেষণ
দুর্যোধনের মনের ভেতরে কী চলছিল?
এই শ্লোকটি আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ বর্ণনামূলক মনে হলেও, এর প্রতিটি শব্দে দুর্যোধনের মনস্তত্ত্ব ফুটে উঠেছে। আসুন, তিনটি প্রধান পয়েন্টে এটি বিশ্লেষণ করি:
১. 'রাজা' দুর্যোধন
সঞ্জয় এখানে দুর্যোধনকে 'রাজা' বলে সম্বোধন করেছেন। যদিও ধৃতরাষ্ট্রই ছিলেন রাজা, কিন্তু অন্ধ পিতার আড়ালে দুর্যোধনই কার্যত রাজ্য শাসন করতেন। সঞ্জয় হয়তো ধৃতরাষ্ট্রকে এটাই বোঝাতে চাইলেন যে, "আপনার ছেলে এখন রাজার মতোই আচরণ করছেন।"
২. ভয়ের প্রথম ইঙ্গিত
দুর্যোধন পাণ্ডবদের সৈন্য সজ্জা বা 'ব্যূহ' দেখলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন পাণ্ডবরা দুর্বল, কিন্তু তাদের সুশৃঙ্খল বিশাল বাহিনী দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। নিজের নার্ভাসনেস বা ভয় ঢাকতেই তিনি কথা বলার জন্য ছুটে গেলেন।
৩. কেন দ্রোণাচার্যের কাছে?
সেনাপতি ছিলেন ভীষ্ম, কিন্তু দুর্যোধন গেলেন গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে। কেন? কারণ দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদেরও গুরু ছিলেন। দুর্যোধনের মনে সন্দেহ ছিল যে, যুদ্ধের সময় গুরু হয়তো পাণ্ডবদের প্রতি দয়া দেখাবেন। তাই যুদ্ধ শুরুর আগেই তিনি গুরুকে খোঁচা দিয়ে উত্তেজিত করতে চাইলেন।
আমাদের জীবনে এই শিক্ষার প্রয়োগ
দুর্যোধনের আচরণ আমাদের শেখায় যে, অহংকার যতই বড় হোক, বাস্তব বিপদের সামনে তা নড়বড়ে হয়ে যায়।
আত্ম-জিজ্ঞাসা:
আমরাও কি কখনো নিজেদের ভুল বা দুর্বলতা ঢাকার জন্য অন্যের সমালোচনা করি? যেমন দুর্যোধন নিজের ভয় ঢাকতে গুরুর কাছে নালিশ করতে গিয়েছিলেন?
সত্যিকারের বীর ভয় পায় না, আর পেলেও তা বিনয়ের সাথে স্বীকার করে। কিন্তু অহংকারী মানুষ ভয়কে ঢাকার জন্য ছলনা ও রাজনীতির আশ্রয় নেয়।
No comments:
Post a Comment