দ্বিজোত্তম! সম্মানের আড়ালে অপমান?
গীতার প্রথম অধ্যায়, সপ্তম শ্লোক
পাণ্ডবদের বিশাল সেনাবাহিনীর বর্ণনা দেওয়ার পর দুর্যোধন এবার নিজের দলের দিকে তাকাচ্ছেন। শত্রুর শক্তি দেখে তিনি কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন, তাই এখন নিজের মনকে শান্ত করতে চাইছেন।
কিন্তু নিজের সেনাপতিদের কথা বলতে গিয়ে তিনি গুরু দ্রোণাচার্যকে এমন একটি বিশেষণে ডাকলেন, যা আপাতদৃষ্টিতে সম্মানজনক মনে হলেও আসলে ছিল এক সূক্ষ্ম খোঁচা।
গীতার বানী: শ্লোক ও সরল অর্থ
দুর্যোধন গুরু দ্রোণাচার্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
"অস্মাকং তু বিশিষ্ট। যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম ।
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ব্রবীমি তে ।।"
(শ্রীমদ্ভাগবদগীতা ১/৭)
সরল বাংলা ভাবার্থ: হে দ্বিজোত্তম (শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ), আমাদের পক্ষে যে সকল প্রধান সেনাপতিগণ আছেন, আপনার অবগতির জন্য আমি তাঁদের কথা বলছি।
গভীর বিশ্লেষণ: 'দ্বিজোত্তম' কেন?
দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে 'সেনাপতি' বা 'আচার্য' না বলে বললেন 'দ্বিজোত্তম', যার অর্থ 'ব্রাহ্মণদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ'। যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সেনাপতিকে তাঁর জাতি বা বর্ণের কথা মনে করিয়ে দেওয়া কেন? এর পেছনে দুর্যোধনের কুটিল রাজনীতি কাজ করছিল:
১. ব্যঙ্গ ও খোঁচা
ব্রাহ্মণদের কাজ পূজা-পাঠ করা, যুদ্ধ করা নয়। দুর্যোধন পরোক্ষভাবে বলছেন, "গুরুদেব, আপনি কি যুদ্ধ করবেন, নাকি ব্রাহ্মণের মতো কেবল শান্তির বাণী শোনাবেন? যদি যুদ্ধ করতে না পারেন তবে আপনি কেবল ভোজ খেতেই প্রাসাদে আছেন।" এটি ছিল গুরুকে তাঁতিয়ে তোলার চেষ্টা।
২. আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ
দুর্যোধন জানতেন দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের ভালোবাসেন। তাই তিনি সন্দেহ করছিলেন যে গুরু হয়তো যুদ্ধের ময়দানে নরম হয়ে যাবেন। 'দ্বিজোত্তম' বলে তিনি মনে করিয়ে দিলেন যে, এখন দয়া দেখানোর সময় নয়, ক্ষাত্রতেজ দেখানোর সময়।
এরপর দুর্যোধন নিজের দলের বীরদের নাম বলতে শুরু করলেন, যাতে গুরুর এবং নিজের মনোবল বৃদ্ধি পায়।
আমাদের জীবনে এই শিক্ষার প্রয়োগ
দুর্যোধনের আচরণ আমাদের দেখায় যে, স্বার্থপর মানুষ নিজের কাজ হাসিল করার জন্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকেও অপমান করতে ছাড়ে না।
শব্দের খেলা বুঝুন:
সব প্রশংসা বা মিষ্টি সম্বোধন সম্মান নয়। কখনো কখনো এর আড়ালে থাকে অন্যের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা। দুর্যোধনের 'দ্বিজোত্তম' সম্বোধন আমাদের শেখায়—শব্দের পেছনের উদ্দেশ্য বোঝা জরুরি।
No comments:
Post a Comment