অন্ধ রাজার ভয় ও যুদ্ধের সূচনা
গীতার প্রথম অধ্যায়, প্রথম শ্লোক
শ্রীমদ্ভাগবদগীতা শুরু হয়েছে ভগবানের কথা দিয়ে নয়, বরং একজন অন্ধ রাজার উৎকণ্ঠা দিয়ে। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে দুই পক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু হস্তিনাপুরের প্রাসাদে বসে ধৃতরাষ্ট্রের মনে কী চলছে?
কেন তিনি সঞ্জয়কে সেই অদ্ভুত প্রশ্নটি করলেন, যা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু জানিয়ে দেয়? আসুন, গীতার একেবারে প্রথম শ্লোকটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি।
গীতার বানী: শ্লোক ও সরল অর্থ
ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে প্রশ্ন করছেন:
"ধৃতরাষ্ট্র উবাচ |
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ |
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয় ||"
(শ্রীমদ্ভাগবদগীতা ১/১)
সরল বাংলা ভাবার্থ: ধৃতরাষ্ট্র বললেন: হে সঞ্জয়, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের কামনায় সমবেত হয়ে, আমার পুত্রেরা এবং পাণ্ডুর পুত্রেরা কী করল?
গভীর বিশ্লেষণ
একটি সাধারণ প্রশ্ন, নাকি ভয়ের বহিঃপ্রকাশ?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ধৃতরাষ্ট্র কেবল যুদ্ধের খবর নিতে চাইছেন। কিন্তু "তারা কী করল?"—এই প্রশ্নটি অদ্ভুত। দুই পক্ষ তো যুদ্ধ করতেই সেখানে গেছে, তারা নিশ্চয়ই বসে গল্প করছে না! তবে কেন এই প্রশ্ন?
আসলে এই শ্লোকের প্রতিটি শব্দের পেছনে লুকিয়ে আছে ধৃতরাষ্ট্রের মানসিক দ্বন্দ্ব ও ভয়। নিচে তিনটি প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:
১. ধর্মক্ষেত্র (পবিত্র ভূমি)
ধৃতরাষ্ট্র স্থানটিকে কেবল 'কুরুক্ষেত্র' বলেননি, বলেছেন 'ধর্মক্ষেত্র'। তিনি জানতেন এটি পবিত্র ভূমি। তাঁর ভয় ছিল, এই পবিত্র স্থানের প্রভাবে তাঁর পুত্রদের (কৌরবদের) মতিগতি বদলে যেতে পারে। তারা হয়তো পাপ কাজ থেকে সরে এসে সন্ধি করে ফেলতে পারে।
২. 'মামকাঃ' (আমার পুত্রেরা)
এখানেই ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বের আসল রূপ প্রকাশ পায়। তিনি কৌরব এবং পাণ্ডব—উভয়কেই নিজের সন্তানের মতো দেখার কথা ছিল। কিন্তু তিনি বললেন "মামকাঃ" (আমার ছেলেরা) এবং "পাণ্ডবাঃ" (পাণ্ডুর ছেলেরা)। এই বিভাজনই যুদ্ধের মূল কারণ।
৩. পাপবোধ ও সংশয়
ধৃতরাষ্ট্র জানতেন পান্ডবরা ধর্মের পথে আছে। আর যে ভূমিতে যুদ্ধ হচ্ছে, তা 'ধর্মক্ষেত্র'। তাই তাঁর অবচেতন মনে ভয় ছিল যে, ধর্মের জয় অবধারিত। তিনি যুদ্ধ চাইছিলেন, কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন।
আমাদের জীবনে এই শিক্ষার প্রয়োগ
ধৃতরাষ্ট্র কেবল একজন ঐতিহাসিক চরিত্র নন, তিনি আমাদের মোহগ্রস্ত মনের প্রতীক। যখন আমরা সত্য এবং ন্যায়ের চেয়ে নিজের স্বার্থ বা 'নিজের লোক' (মামকাঃ)-কে বেশি গুরুত্ব দিই, তখনই আমাদের জীবনে কুরুক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়।
আত্মোপলব্ধি:
আমাদের মনের ভেতরেও কি এমন কোনো 'অন্ধ রাজা' বসে আছে? যে সব জেনেও অন্যায়ের পক্ষ নেয় কেবল আসক্তির কারণে?
গীতার প্রথম শ্লোক আমাদের শেখায় যে, আসক্তিই আমাদের জ্ঞানচক্ষু অন্ধ করে দেয় এবং ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত করে।
No comments:
Post a Comment