Wednesday, 19 November 2025

কুরুক্ষেত্র যখন মনের ভেতরে

গীতা ১৬.৬: অন্তরের দ্বন্দ্ব

কুরুক্ষেত্র যখন মনের ভেতরে

আমাদের অন্তরের দেবতা ও অসুরের দ্বন্দ্ব

😇
😈

মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কেবল একটি ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক ঘটনা নয়, এটি প্রতিনিয়ত ঘটে চলা আমাদের মানসিক দ্বন্দ্বের এক রূপক। আমরা প্রায়ই বাইরের জগতের ভালো-মন্দ নিয়ে বিচার করি, কিন্তু আমাদের নিজেদের মনের ভেতরে যে নিরন্তর যুদ্ধ চলছে, তার খবর কি আমরা রাখি?

আমরা শ্রীমদ্ভাগবদগীতার ১৬তম অধ্যায়ের ৬ষ্ঠ শ্লোক অবলম্বনে এই গভীর দার্শনিক তত্ত্বটি অন্বেষণ করব। চলুন, আমাদের অন্তরের এই দুই শক্তিকে চিনে নিই।


গীতার বানী: শ্লোক ও সরল অর্থ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে মানুষের স্বভাবকে দুই প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন—একদিকে দিব্য বা দৈব ভাব, অন্যদিকে আসুরিক ভাব।

"দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেঽস্মিন্ দৈব আসুর এব চ।
দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু।।"

(শ্রীমদ্ভাগবদগীতা ১৬/৬)

সরল বাংলা ভাবার্থ: হে পার্থ (অর্জুন), এই জগতে সৃষ্ট প্রাণীদের স্বভাব প্রধানত দুই প্রকার—'দৈব' (দিব্য) এবং 'আসুর' (আসুরিক)। আমি ইতিপূর্বে দৈব গুণাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছি। এখন আমার কাছ থেকে আসুরিক স্বভাব সম্পর্কে শ্রবণ করো।


পৌরাণিক বিশ্লেষণ

দেবতা ও অসুর আসলে কোথায় থাকে?

এই শ্লোকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এখানে শ্রীকৃষ্ণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, অসুর মানেই বড় দাঁত আর শিং-ওয়ালা কোনো দানব নয়; এটি একটি 'প্রবৃত্তি' বা 'স্বভাব'

এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় একটি দারুণ পৌরাণিক বিবর্তনের তত্ত্ব (Evolution of consciousness) পাওয়া যায়, যা যুগভেদে অশুভ শক্তির অবস্থান নির্দেশ করে। নিচে চারটি যুগের বিবরণ দেওয়া হলো:

১. সত্য যুগ

পুরাণে বলা হয়, সত্য যুগে দেবতা এবং অসুররা আলাদা আলাদা লোকে বা গ্রহে বাস করত। তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল।

২. ত্রেতা যুগ

দ্বন্দ্ব কাছে এলো। দেবতা এবং অসুররা একই গ্রহে, কিন্তু আলাদা রাজ্যে বাস করতে শুরু করল (যেমন অযোধ্যার রাম ও লঙ্কার রাবণ)।

৩. দ্বাপর যুগ

দ্বন্দ্ব আরও ঘনীভূত হলো। এবার তারা একই পরিবারে জন্ম নিল (যেমন পান্ডব ও কৌরব)। এক ভাই দৈব গুণসম্পন্ন, তো অন্য ভাই আসুরিক।

৪. কলি যুগ (বর্তমান)

আর এখন? কলিযুগে দেবতা এবং অসুর আর আলাদা গ্রহে বা আলাদা পরিবারে নেই। তারা এখন একই মানুষের হৃদয়ে, একই মনে বাস করে।

কেন শ্রীকৃষ্ণ আসুরিক স্বভাব সম্পর্কে শুনতে বললেন?

লক্ষ্য করুন, কৃষ্ণ বলছেন, "আমি দৈব গুণগুলো বলেছি, এবার আসুরিক গুণগুলো শোনো।" কিন্তু কেন? ভালো জিনিসের কথা বলাই তো যথেষ্ট ছিল!

আসলে, শত্রুকে না চিনলে যুদ্ধে জেতা যায় না। আমাদের আধ্যাত্মিক পতন ঘটানোর জন্য যে 'অসুর' আমাদের মনের কোণে লুকিয়ে আছে, তাকে চিনতে হবে। অহংকার, দম্ভ, ক্রোধ, কঠোরতা—এগুলোই সেই আসুরিক লক্ষণ। শ্রীকৃষ্ণ এই অধ্যায়ে অশুভকে বিস্তারিত বর্ণনা করছেন যাতে আমরা আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে পারি এবং সংশোধন করতে পারি।


আজকের জীবনে এই শিক্ষার প্রয়োগ

আমরা আধুনিক মানুষরা প্রায়ই 'আইডেন্টিটি ক্রাইসিস' বা অস্তিত্ব সংকটে ভুগি। গীতার এই শ্লোক আমাদের শেখায় যে, আমাদের ব্যক্তিত্ব কোনো একরৈখিক বিষয় নয়। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই একটুখানি 'দৈব' ভাব আছে, আবার একটুখানি 'আসুরিক' ছায়াও আছে।

আমাদের কাজ হলো সচেতনভাবে নিজের ভেতরের সেই আসুরিক প্রবৃত্তিটিকে চেনা এবং তাকে খাবার না দেওয়া।

প্রতিদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন—
"আজ আমার কাজে ও ব্যবহারে কে জিতবে? আমার ভেতরের দেবতা, নাকি আমার ভেতরের অসুর?"

গীতার এই জ্ঞান শুধু অর্জুনের জন্য নয়, এই কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি আধুনিক মানুষের জন্য।

গীতার আলোয় পথচলা

শ্রীমদ্ভাগবদগীতার ১৬/৬ শ্লোকের উপর ভিত্তি করে একটি উপস্থাপনা।

No comments:

Post a Comment