ভীষ্ম বনাম ভীম: অদ্ভুত তুলনা
গীতার প্রথম অধ্যায়, দশম শ্লোক
দুর্যোধন তাঁর গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে দুই পক্ষের শক্তির তুলনা করছেন। কিন্তু এই তুলনা করতে গিয়ে তিনি এমন এক অদ্ভুত দাবি করে বসলেন, যা তাঁর অহংকার এবং অবচেতন মনের ভয়—উভয়কেই প্রকাশ করে।
তিনি পিতামহ ভীষ্মের সাথে ভীমের তুলনা টানলেন। কিন্তু কেন? এবং তাঁর গণনায় ভুলটা কোথায় ছিল?
গীতার বানী: শ্লোক ও সরল অর্থ
"অপর্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্ ।
পর্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ ।।"
(শ্রীমদ্ভাগবদগীতা ১/১০)
সরল বাংলা ভাবার্থ: পিতামহ ভীষ্ম দ্বারা সুরক্ষিত আমাদের শক্তি অপরিমিত (অজেয়); কিন্তু ভীম দ্বারা সুরক্ষিত পাণ্ডবদের শক্তি পরিমিত (সহজেই জয় করা সম্ভব)।
গভীর বিশ্লেষণ: দুর্যোধনের গণিত
দুর্যোধন এখানে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন: 'অপর্যাপ্তম্' (Unlimited/Invincible) এবং 'পর্যাপ্তম্' (Limited/Conquerable)। তাঁর এই আত্মবিশ্বাসের কারণ কী?
১. ভীষ্মের অপরাজেয়তা
দুর্যোধন জানতেন পিতামহ ভীষ্ম 'ইচ্ছামৃত্যু'র বর পেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি নিজে না চাইলে তাঁকে কেউ মারতে পারবে না। তাই ভীষ্মের নেতৃত্বে তাঁর সেনাদলকে তিনি 'অজেয়' মনে করছেন।
২. ভীম কেন?
পাণ্ডবদের সেনাপতি ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন, কিন্তু দুর্যোধন নাম নিলেন ভীমের। কারণ? ভীম ছিলেন দুর্যোধনের ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ছোটবেলা থেকেই ভীমের শক্তি দুর্যোধনের ভয়ের কারণ ছিল। তিনি ভীমকে খাটো করে দেখে নিজেকে সাহস জোগাচ্ছিলেন।
ভাগ্যের পরিহাস
স্বামী মুকুন্দানন্দের মতে, দুর্যোধন এখানে একটি প্রবাদের জীবন্ত উদাহরণ: "বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি"। তিনি ভুলে গেছেন যে, ভীষ্ম কৌরবদের পক্ষে থাকলেও মনে-প্রাণে পাণ্ডবদের ভালোবাসেন এবং জানেন যে ধর্ম পাণ্ডবদের পক্ষে। আর যেখানে ধর্ম এবং স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আছেন, সেখানে 'ইচ্ছামৃত্যু'র বরও হার মানতে বাধ্য।
আমাদের জীবনে এই শিক্ষার প্রয়োগ
আমরাও কি দুর্যোধনের মতো বাহ্যিক শক্তি বা রিসোর্স (টাকা, ক্ষমতা, যোগাযোগ) দেখে নিজেদের 'অজেয়' ভাবি?
পরিমাণ বনাম গুণমান:
দুর্যোধনের সেনা সংখ্যায় বেশি ছিল (১১ অক্ষৌহিণী বনাম ৭ অক্ষৌহিণী)। কিন্তু পাণ্ডবদের ছিল সত্য ও কৃষ্ণের সমর্থন। জীবনে সাফল্যের জন্য কেবল 'রিসোর্স' বা উপকরণের প্রাচুর্য যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সঠিক উদ্দেশ্য এবং নৈতিক সমর্থন।
No comments:
Post a Comment